এনবিএন ডেক্সঃ জীবনের চাকা ঘুরে সাতাত্তরে পৌঁছলেও ভাগ্যের চাকা ঘুরেনি বৃদ্ধ খয়বর আলীর। এখনো তিনি রিক্স টেনেই জীবীকা নির্বাহ করছেন। পরিচিত ওই মুখটি শহরময় টেনে চলেছেন রিক্সা। অপরিচিতরা অবাক বিস্ময়ে চেয়ে চেয়ে দেখেন বৃদ্ধ রিক্সাওয়ালা খয়বর চাচাকে। অসুস্থ্য শরীর, রোদ, বৃষ্টি আর তীব্র শীতেও জীবিকার সন্ধানে ১৯৫২ সাল থেকে রিক্স্র চালিয়ে যাচ্ছেন নওগাঁর খয়বর আলী। সবাই তাঁকে ডাকেন খয়বর চাচা বলে। ১৯৩৭ সালে জন্মের পর মাত্র ১৩ বছর বয়সে সংসারে অভাবের কারনে রিক্্রার প্যাডেলে পা রাখতে বাধ্য হন খয়বর আলী। সেই যে শ্রমের শুরু সেই থেকেই ৭৭ বছর বয়সে এসেও একমাত্র উপার্জনের পথ ওই রিক্স্রা। বড় ২ মেয়ে ৪ ছেলের কেউই খোঁজ রাখেনা বৃদ্ধ পিতার। স্বভাবগত কারনে পরিশ্রমি মানুষটি কারো কাছে হাত পেতে কিছুই চাইতে পারেননা। যেদিন তাঁর রিক্্রায় যাত্রী চড়েনা সেদিন হয়তো খাবারও জোটেনা। এভাবেই চলছে খয়বর আলীর জীবন। সামাদ, হোসেন, লজির, আবুল, মজি, ছিলেন তাঁর বন্ধু। আজ আর তাঁরা কেউ বেঁচে নেই। র্নিবন্ধু মানুষটি এখনো টেনেই চলছেন সংসারের ঘানি। নওগাঁ সদরের আরজী নওগাঁ স্কুলের পিছনে মৌলভিপাড়ার ভাঙ্গা নড়বরে জড়াজির্ন বাড়িতে কোনভাবে মাথা গুঁজে রয়েছেন স্ত্রী ফরিদা বেগম ও ছোট ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে। দিন দিন শরীরের সাথে রিক্স্রটিও নানান ব্যধিতে আক্রান্ত হচ্ছে তাঁর। তাঁর দীর্ঘদিনের শ্রম আর জীবনের কথা বললেন খয়বর আলী, আমি বক্তারপুরের আফজার রিক্সা প্রতিদিন ১টাকা জমা দিয়ে নেই। তখন আমার বয়স ১৩ বছর। নওগাঁ শহরে হাতে গোনা কয়েকটি রিক্সা ছিল। রাস্তা ছিল খোয়া বিছানো আর কাঁচা। পাকা রাস্তা শহরে ছিলনা। রিক্সা চালানোর চেয়ে টেনেই নিয়ে যেতে হতো বেশী। সবাই রিক্সায় উঠতো না। শহরে ছিল অনেক ঘোড়ার গাড়ি। ওতেই মানুষ বেশী যাতায়াত করতো। আমি শহরের কালিতলার মোড়ের স্ট্যান্ডে সামাদ, হোসেন, লজির, আবুল, মজি’র সাথেই রিক্সা চালাতাম। ওরাতো আজ আর কেউ বেঁচে নেই। কালিতলার মোড় থেকে বাঙ্গাবাড়িয়ার মোড় (বর্তমানে ডিগ্রী কলেজ প্রায় ৩ কিঃমিঃ) ভাড়া ছিল ১৪ পয়সা। নওগাঁর কালিতলার মোড় থেকে সান্তাহার জংশন (৬ কিঃমিঃ) ভাড়া ছিল চার আনা। শহরের ভাড়া ছিল এক আনি, দুই আনি, পাঁচ পয়সা, দশ পয়সা। তখন ছিল বৃটিশের চাঁদ দাগানো ফুটো পয়সা আর মন্ডু (মাথা) ওয়ালা কাঁচি টাকা। মানুষ তখন সখের বসেই রিক্স্রায় উঠতো। জমার টাকা দুপুরের মধ্যেই উঠে যেতো। রিক্স্র ছিল শহর জুড়ে ১০/১২টি। সন্ধ্যায় বোর্ড অফিস থেকে রাস্তার মোড়ে মোড়ে থাম্বার মাথায় লইটম্যান কেরোসিনের বাতি জ্বালিয়ে দিত। রাস্তা-ঘাটের দুধারে ছিল বাঁশ ঝার আর জঙ্গল। সন্ধ্যা নামলেই নানান প্রানি বেড়িয়ে পরতো। খয়বর আলী জীবনে শুধূ একবারই দূর্ঘটনার শিকার হন। তিনি বললেন তখন সান্তাহারে সাইলো (দেশের প্রথম গম সংরক্ষানাগার) নির্মানের কাজ চলছিল। সেখান থেকে নওগাঁ শহরে এসেছিলেন এক সাহেব। তাঁকে সান্তাহারে পৌঁছে দিতে গেলে মাঝ পথে তুলসীগঙ্গা ব্রীজের উঁচুতে উঠতেই রিক্স্রটি উল্টে যায়। সাহেব ছিলেন খুব ভারি। তিনি আঘাত পেয়েছিলেন খুব। কিন্তু আমাকেই তিনি রিক্স্রার নিচ থেকে টেনে তুলে আনেন। আর আমার রিক্স্রটিও রাস্তায় উঠিয়ে নিয়ে আসেন। তাঁর শরীরে আঘাত উপেক্ষা করে তিনি বার বার আমার আঘাতের কথা জিজ্ঞেস করছিলেন। সেদিন সান্তাহারে পৌঁছে আমার চার আনার ভাড়ার স্থলে একটি কাঁচি টাকা দিয়েছিলেন ওই সাহেব। খয়বর আলির প্রথম স্ত্রীর বিয়োগের পর দ্বিতীয় স্ত্রী ফরিদা বেগমকে বিয়ে করেন। বর্তমানে ফরিদা বেগম কাবিখা প্রকল্পের মাটি কাটার কাজ করছেন বৃদ্ধ স্বামীর সংসারে আর্থিক সহযোগিতার জন্য। খয়বর আলী আক্ষেপ করে বলেন জীবনে প্রথম ভাড়া পেয়েছিলাম চাঁদ দাগানো ফুটো পয়সা। সেই ভাগ্য আমার ফুটোই থেকে গেল।