7 Agrohayon 1431 বঙ্গাব্দ শুক্রবার ২২ নভেম্বর ২০২৪
সদ্যপ্রাপ্ত সংবাদ »
Home / জাতীয় সংবাদ / বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের চিন্তা চেতনা ও কর্মে পতিসর

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের চিন্তা চেতনা ও কর্মে পতিসর


॥ মোঃ আবুবকর সিদ্দিক ॥
পল্লীর উন্নয়ন ও কর্ম পরিকল্পনার রুপকার ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এ পরিকল্পনার বাস-বায়ন হিসাবে এবং মহাজনদের হাত থেকে কৃষকদের মুক্ত করতে সমবায় পদ্ধতিতে ১৯০৫ সালে কালিগ্রাম পরগনার পতিসরে কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেছিলেন । এ এলাকার মানুষকে শিক্ষিত করার লক্ষ্যে পুত্রের নামে স্কুল স্থাপন করেছিলেন।

বাংলা সাহিত্যের পুরোধা ও কপালে রাজটিকা পরিহিত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর জীবনের সিংহ ভাগই কাটিয়েছেন পদ্মা, ইছামতি, নাগর, আত্রাই নদী বিধৌত উত্তরবঙ্গের সবুজ শ্যামল ছায়াঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা নাগর নদীর তীর পতিসরে। যদিও তিনি এখানে এসেছিলেন জমিদারী পরিচালনার কাজে তবুও তাঁর সাহিত্য জীবনে অনন্য উপাদান তিনি সংগ্রহ করেছিলেন এ প্রকৃতি ভান্ডার থেকেই। এখানে এসে মুগ্ধ হয়েছিলেন কবিগুরু। পল্লী বাংলার সাধারন মানুষ, চাষী, মুটে-মজুর, হিন্দু, মুসলমান প্রজা, নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধসহ ক্ষেত খামার ও হাল লাঙ্গল এসবই তাঁর মনের মাটিতে একাকার হয়ে যায়। তাঁর সাহিত্যে ও চিত্রকর্মে পতিসরের ছবিই সবচেয়ে পরিষ্কার ফুটে উঠেছে। জমিদারী দেখাশুনা করতে তিনি ঘুরে বেড়াতেন তিনটি জেলায়। কিন’ তাঁর হৃদয় ভরে থাকতো পতিসরের মধুময় স্মৃতি।
ক্রয়সূত্রে ১৮৩০ সালে রবীন্দ্রনাথের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর কালিগ্রাম পরগনা জমিদারির অন্তর্ভূক্ত করেন। পতিসর কালিগ্রাম পরগনার সদর দপ্তর। নওগাঁ , বগুড়া ও নাটোর জেলার ৬ শ টি গ্রাম নিয়ে কালিগ্রাম পরগনা গঠিত। এর আয়তন ছিল ২৩০ বর্গমাইল। রাতোয়াল আর ভান্ডারগ্রাম আরো দুটি সাব কাচারী ছিল। রাতোয়াল পতিসর থেকে ১০ কিলোমিটার আর ভান্ডারগ্রাম ২০ কিলোমিটার উত্তরে অবসি’ত। কালিগ্রাম পরগনার সীমানা ছিল উত্তরে মালশন আদমদিঘী দক্ষিনে আত্রাই নদী, পূর্বে নাগর নদীর পশ্চিম তীর আর পশ্চিমে নাগর বিধৌত বাঁকা-কাশিয়াবাড়ি গ্রাম। কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের বাংলাদেশে ছিল ৩ টি জমিদারী। পতিসরে কবির গুরুর আসা ইচ্ছাকৃত ভাবে নয়, অনেকটাই ভাগ্যক্রমে । এজমালি সম্পত্তির সবশেষ ভাগে বিরাহিমপুর ও কালিগ্রাম পরগনার মধ্যে সত্যেন্দ্র পুত্র সুরেন্দ্রনাথকে তাঁর পছন্দের অংশ বেছে নিতে বললে সে তখন বিরাহিমপুরকে পছন্দ করে তখন স্বভাবতই রবীন্দ্রনাথের অংশে এসে পরে কালিগ্রাম পরগনা যার সদর পতিসর।

আঁকা-বাঁকা ছোট্র নদী নাগরের তীরে অবসি’ত এই পতিসর। পূর্ব-দক্ষিনে চলন বিল ও আত্রাই নদী। পশ্চিম-উত্তরে রক্তদহ বিল। অসংখ্য খাল-বিল, নদী-নালা পরিবেষ্টিত কালিগ্রাম পরগনা। (সেই সময়) বছরের প্রায় ৬ মাস পানিতে ডুবে থাকতো। তখন গ্রাম গুলোকে মন হতো যেন এক একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। রবীন্দ্রনাথ সর্ব প্রথম এ বিচ্ছিন্ন দ্বীপে আসেন ১৮৯১ সালে। প্রথমে পতিসর তাঁকে ভাল লাগেনি। কিন’ পরবর্তীতৈ পতিসরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাঁকে মুগ্ধ করে। মুগ্ধ করে কালীগ্রামের সহজ সরল প্রজা সাধারনের ভক্তি ও শ্রদ্ধা। এখানে এসে তিনি কৃষকদের খুব কাছাকাছি আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। এতে কৃষকের অর্থনীতি সম্পর্ককে ভালো ধারনা জন্মেছিল। পতিসরের প্রতি রবীন্দ্রনাথের ছিল অগাধ ভালবাসা, ছিল এখানকার মানুষের প্রতিও। তার বিচক্ষনতা দিয়ে প্রজাহ্নদয় জয় করেছিলেন। জমিদারি পরিচালনা পদ্ধতিও ছিল আধুনিক ও বিজ্ঞান সম্মত। তাই তিনি তাদের আপনজন হয়ে যান। তখন প্রজা ও জমিদারের সম্পর্কের ব্যবধান কমে আসে।

তিনি অনুন্নত পরগনার রাস্তা-ঘাট শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও দারিদ্র বিমোচনসহ নানাবিধ উন্নয়নমূলক কর্মসূচি হাতে নেন। কর্মসূচির মধ্যে ছিল গ্রামে গ্রামে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি শিল্প, ব্যাংক স্থাপন, রাস্তাঘাট নির্মান, কূপ, দীঘি ও পুকুর খনন, জঙ্গল পরিস্কার, গ্রাম্য শালিশী ব্যবস্থাও মহাজনের সুদের হাত থেকে দরিদ্র প্রজাদের রক্ষা করা। এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য পরগনাকে ৩টি বিভাগে ভাগ করেন। কালিগ্রাম ”হিতৈষী সভা” নামে একটি সংগঠন তৈরী করেন। কালীগ্রাম পরগনার প্রজাদেরকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে পতিসর, রাতোয়াল ও কামতা ৩টি বিভাগে ৩টি মধ্য ইংরেজী (এম.ই) স্কুল ও পতিসরে ছেলে রথীন্দ্রনাথের নামে ১টি হাইস্কুল স্থাপন করেন। স্কুলের ভবন, ছাত্রাবাস নির্মাণ ও অন্যান্য খরচ এস্টেট থেকে বহন করা হতো। পতিসরে অবসি’ত কালীগ্রাম রথীন্দ্রনাথ ইনষ্টিটিউশনের প্রথমে নাম ছিল পতিসর এম.ই স্কুল। পরবর্তীতে ১৯৩৭ সালে বিদ্যালয়টি হাইস্কুলে রুপান-রিত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এটি ছিল নওগাঁর জেলার তৃতীয় হাইস্কুল। ১৯১৩ সালের জানুয়ারী মাসে রাতোয়াল বিভাগে একটি বিদ্যালয় এবং কামতায় আরো একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠান গুলোর প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই।
একথা বলা মোটেই অত্যুক্তি হবে না যে, পূর্ব বাংলায় ’জমিদারি’ করতে এসে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতই নিজেকে আবিস্কার করেছিলেন নতুন করে। পতিসরে বসেই তিনি গোরা ও ঘরে বাহিরে (অংশ বিশেষ) উপন্যাস, ছোট গল্প ’প্রতিহিংসা’ ও ঠাকুরদা, লিখার রসদ পেয়েছিলেন। পূর্ণিমা, সন্ধ্যা, চৈতালি-মধ্যাহ্ন, পল্লীগ্রামে, সামান্য লোক, দুর্লভ জন্ম, খেয়া, কর্ম , মেঘদূত, দিদি , পরিচয়, অনন্ত পথে ’র মত অনেক কবিতা রচনা করেছিলেন। রচনা করেছিলেন কিছু হৃদয় স্পর্শ করার মত গান যেমন বিধি ডাগর আখি—-, জলে ডোবা চিকন শ্যামল—-, বধু মিছে রাগ করো না—-, আমি কান পেতে রই —, তুমি নব রুপে এসো প্রানে—-।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর হৃদয়ের অন-ঃস’লে অনুভব করেন দরিদ্র প্রজাদের দুঃখ দুঃদশার কথা। জমিদারি পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি কখনও প্রজা পীড়ক হতে পারেননি। উল্টো দিকে তিনি খাজনা মওকুফ করেছিলেন তার সমগ্র জমিদারীতে। পল্লীর উন্নয়ন ও কর্ম পরিকল্পনার রুপকার ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এ পরিকল্পনার বাস-বায়ন হিসাবে এবং মহাজনদের হাত থেকে কৃষকদের মুক্ত করতে সমবায় পদ্ধতিতে ১৯০৫ সালে কালিগ্রাম পরগনার পতিসরে কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেছিলেন । নোবেল পুরস্কারের ১লক্ষ ৮ হাজার টাকা এই ব্যাংকে বিনিয়োগ করা হয়। ১৯১০ সালে উত্তরবঙ্গের মহাপ্লাবনের পর আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় মহাশয়ের বন্যাত্রাণ ফান্ডে কিছু টাকা উদ্বৃত্ত হইয়াছিল এবং এই টাকায় আমেরিকা হইতে কয়েকটি ট্রাক্টর ক্রয় করা হয়। রবীন্দ্রনাথ একটি ট্রাক্ট্রর লইয়া পতিসর অঞ্চলে কলের লাঙ্গল দিয়া জমি চাষ প্রবর্তন করেন। ট্রাক্ট্রর পাওয়া গেলে, কিন’ চালক পাওয়া গেল না। পুত্র রথীন্দ্রনাথ আমেরিকায় কৃষিবিদ্যা শিক্ষাকালে ট্রাক্ট্রর চালনা করিয়াছেন। পতিসরে তাই তিনি ট্রাক্ট্ররের ড্রাইভার রুপে আশে পাশে জমি চাষ করিয়াছেন। যন্ত্রদানবের কার্যকলাপ দেখিতে প্রথম দিন হাজার হাজার লোক পতিসরে উপসি’ত হইয়াছিল।
১৮৯১-১৯৩৭ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ জমিদারি পরিচালনা করেছিলেন পতিসরে । পতিসরকে রেখে ১৯৩৭ সালে অশ্রুসিক্ত চোখে কবি শেষ বারের মত বিদায় নিলেন, মানুষ কাঁদালেন, কবি নিজেও কাঁদলেন। তখন তাঁর বয়স ছিল ৭৬ বছর। ১৯৪৭ সালের আগ পর্যন্ত পতিসর কুঠির বাড়ি কর্মমূখর ছিল। ১৯৪৭ সালের পর থেকেই ক্রমাগত বিলুপ্তি হতে থাকে, কবির সাজানো বাগান হারিয়ে যেতে থাকে কাচারী বাড়ির সকল জিনিসপত্র। দেশ বিভাগের পর ১৯৫২ সালের অর্ডিন্যান্স বলে তদানীন্তন পূর্বপাকিস্থান সরকার এই জামিদারি অধিগ্রহন করে। সুদীর্ঘ প্রায় ৫০ বৎসর পর ১৯৯১ সালের তৎকালীন বিএনপি সরকারের সিদ্ধানে-র ফলে তৎকালীন নওগাঁ-৬ আসনের সংসদ সদস্য আলমগীর কবিরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় পতিসরে প্রথম সরকারীভাবে রবীন্দ্রনাথের জন্মবার্ষিকী পালন হতে থাকে। ছিল না কোন পাকা রাস্তা ঘাট। জমির পাশ দিয়ে কোন রকমে মানুষ যাতায়াত করত। আর কাচারী বাড়ীতে যাওয়ার রাস্তা পাড়ার বাড়ী গুলোর পাশ দিয়ে কোন রকমে হেটে যাওয়া ছাড়া কোন যানবাহন যেত না। পরবর্তীতে পতিসরকে ঘিরে পাকা রাস্তা ঘাট, বাজার, ডাক বাংলোসহ ইত্যাদি করে সেখানে জাতীর কাছে রবীন্দ্রনাথের কাচারী বাড়ী পতিসরকে রবীন্দ্র ভক্তদের ও সাধারন মানুষের কাছে নতুন করে নতুন আঙ্গিকে পরিচিত হতে থাকে। ৯১ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত সরকারী ভাবে রবীন্দ্র জন্ম জয়ন্তী পালন করে থাকে। এ উপলক্ষ্যে সেখানে নামে রবীন্দ্র ভক্ত ও অনুরাগীদের ঢল। ৭ দিন ব্যাপী চলে গ্রামীন মেলা। হাজার হাজার লোকের পদচারনায় মুখরিত করে তোলে কাচারী প্রাঙ্গন।
রবীন্দ্রনাথের তৈরী কৃষি ব্যাংকের স’লে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের শাখা হয়েছে পতিসরে। কাঁচা রাস্তার জায়গায় পাকা রাস্তা হয়েছে। এখন এলাকার মানুষের প্রাণের দাবী পতিসরে রবীন্দ্রনাথের নাম অনুসারে একটি কলেজ ও একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হোক। গড়ে উঠুক রবীন্দ্র সংগ্রহশালা । এ লক্ষ্যে বর্তমান সংসদ সদস্য ইসরাফিল আলম মনে প্রাণে কাজ করে যাবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। এলাকবাসী ও রবীন্দ্র ভক্তদের একটাই দাবি পতিসর যেন বাংলার ইতিহাসে অম্লান হয়ে রয় চিরদিন।
এদিকে জেলা প্রশাসন আয়োজিত ২ দিন ব্যাপী কবিগুরুর ১৫১ তম জন্মউৎসব , মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। প্রধান অতিথি থাকবেন, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশানের মেয়র এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন, বিশেষ অতিথি থাকবেন, ইস্রাফিল আলম এমপি, কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, সাহিত্যিক ও গবেষক শান্তনু কায়সার, জেলা পরিষদের প্রশাসক ও আওয়ামীলীগের সভাপতি এ্যাডঃ ফজলে রাব্বী, পুলিশ সুপার ওয়াই এম বেলালুর রহমান সহ আরও রবীন্দ্র গবেষক। সভাপতিত্ত্ব করবেন জেলা প্রশাসক ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম। এ উপলক্ষ্যে সেখানে বসবে একটি গ্রামীণ মেলা। আলোচনা শেষে কবিতা, মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও নৃত্য পরিবেশিত হবে।

আরও পড়ুন...

নওগাঁয় ৯টি ককটেল ১৫ টি সাউন্ড বোমাসহ বিপুল পরিমান জিহাদী বই উদ্ধার- ৬ শিবির নেতাকর্মীকে আটক করেছে পুলিশ

এনবিএন ডেক্সঃ নওগাঁ সদরের শহরস্থ নামাজগড় মাদ্রাসা পাড়া থেকে ৯টি ককটেল, ১৫ টি সাউন্ড বোমা …